মোগলমারী বৌদ্ধমহাবিহার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের খোঁজে।
মোগলমারী হলো পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন ব্লকের প্রতন্ত এক গ্রাম। গ্রামের লোকেরা মনেকরেন এক সময় এই অঞ্চলে মোঘল ও পাঠানদের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়েছিলো, তাতে প্রচুর মোঘল সৈন্য মারা গিয়েছিলো তাই এই অঞ্চলের নাম হয় মোগলমারী। যদিও এটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। আজকে মোগলমারী জগতে বিখ্যাত সেখানকার প্রত্নাআবিষ্কারের জন্য। এখানে খনন কার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে খিষ্ট্রীয় ষষ্ট শতকের এক বৌদ্ধ মহাবিহারের।
তখন মোঘলমারি গ্রামবাংলার আর পাঁচটা গ্রামের মতো একটা গ্রাম। গ্রামের একদিকে উঁচু একটা ঢিবি, যার নাম সকিসেনা ঢিবি, ঢিবির পাশে গ্রামের লোকেরা ক্লাব বানিয়েছে যেটা আসলে থিয়েটারের স্টেজ, ঢিবিতে বোসে লোক থিয়েটার দেখে।
দাঁতনের স্থানীয় শিক্ষক নরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস মহাশয়ের মোনে এসেছিলো ওই সকিসেনা ঢিবির মধ্যে প্রত্নতাত্বিক সম্ভাবনা থাকতে পারে। তাই তিনি তার মনের কথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর অশোক দত্ত কে জানিয়ে ছিলেন।
চাইনিস পরিব্রাজক হিউএনসাঙ এর লেখা বইয়ের বর্ণনা থেকে জানা যায় তাম্রলিপ্ততে এক হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর জন্য দশটি বৌদ্ধ বিহার তৈরী করা হয়েছিলো। এছাড়াও তাম্রলিপ্ততে সম্রাট অশোক একটি বৌদ্ধ স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন।
যাতে চারটি বুদ্ধ মূর্তি ছিলো। এতদিন পর্যন্ত এই অঞ্চলে আর কোনো বৌদ্ধ বিহারের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর অশোক দত্ত স্থানীয় শিক্ষক নরেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের কথায় উৎসাহিত হোয়ে 2003-2004 শিক্ষাবর্ষে প্রথম একদল আর্কিওলজিস্ট নিয়ে সকিসেনা ডিবিতে খননকার্য শুরু করেন। সেবার বেশকিছু প্রত্ন নিদর্শন মিললো। 2006-2007সালে ডিবির পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে খননকার্য হোয়ে ছিলো। 2007-2008খননকার্যে ডিবির ভূমিস্থিত স্থাপত্য এটিকে বৌদ্ধ মঠ হিসাবে চিন্নিত করেছিল। 2010ও 2011একটি কোরে পর্যায়ে ও 2012তে দুটি পর্যায়ে খনন কার্য হয়। 2012তে ডক্টর অশোক দত্ত মারা যান এতে খননকার্য কিছুদিনের জন্য বন্ধ হোয়ে যায়। এর পর পুনরায় খনন কার্য শুরু হয় ডিরেক্টর অফ ষ্টেট আর্কিওলজি অমল রায়ের নেতৃত্বে। যত বার খননকার্য হয়েছে ততো নতুন নতুন তথ্য উঠে এসেছে। এবার
শিলালিপি থেকে জানা গেলো এই বৌদ্ধ বিহারের নাম শ্রী বন্দক মহাবিহার আর্য ভিক্ষু সঙ্গ। খননকার্যের ফলে জানা যায় বৌদ্ধ বিহারটি তিন বারে তৈরী হোয়ে ছিলো। এর আয়তন দৈঘ্যে ষাট মিটার, প্রস্থে ষাট মিটার। যা তৈরী হয়েছিলো খিষ্ট্রীয় ষষ্ট শতকে। খিষ্ট্রীয় দ্বাদশ, ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত এই বৌদ্ধ বিহারে নানা উত্থান পতনের ঘটনা ঘটেছে। বৌদ্ধ বিহারের বাইরের দেওয়ালে শোলটি স্টাকো ফিগার পাওয়া গেছে এছাড়া পদ্যের ডিজাইন পাওয়া গেছে যেগুলি নালন্দা ও সারনাথের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রধান ফটকের সামনে দুটি বড়ো পিলাররের মতো ছিলো। বারে বারে খননকার্যের ফলে জানা যায় এখানে ছিলো বৌদ্ধ লামাদের থাকার ঘর, উপাসনা ঘর, এখানে পাওয়া গেছে স্লেট পাথরের বুদ্ধমূর্তি, স্টাকো মূর্তি, মাটির নকশা করা পাত্র, পোড়া মাটির সিল, পোড়া মাটির ফলক, সোনার অলংকার, সোনার মুকুট, সোনার মুদ্রা, ত্রিধাতুর মুদ্রা যেগুলি খ্রিষ্টিয় ষষ্ট শতকের।বর্তমানে এইসব প্রত্ন নিদর্শন গুলি সংরক্ষিত হয়েছে বেহালা মিউজিয়ামে। অল্প কিছু প্রত্ন নিদর্শন ও প্রত্ন নিদর্শনের ছবি রয়েছে বৌদ্ধ বিহারের মধ্যের ক্লাব মোগলমারী তরুণ সেবা সংঘ ও পাঠাগারে। ক্লাবের সদস্য চন্দ্র বাবু ক্লাবের চাবি খুলে আমাদের তাঁদের ছোট্ট মিউজিয়াম খানি দেখতে দিলেন এবং খননকার্যের ফলে কোন জায়গা থেকে কি পাওয়া গেছে সব খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিলেন। একপ্রকার গাইডের কাজকরলেন।
অধ্যাপক দত্ত মোনে করতেন বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের আমলে অর্থাৎ খিষ্ট্রীয় ষষ্ঠ শতকে মোঘলমারী বা প্রাচীন অমরা বতিতে বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর মতে একদিকে ত্রাম্রলিপ্তের মতো প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র আর অন্য দিকে কলিঙ্গর মতো বৌদ্ধ ঐতিহাসিক ক্ষেত্র পাশে থাকায় এই অঞ্চল বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের আদর্শ জায়গা হোয়ে ওঠে।
বৌদ্ধ কিংবদন্তি থেকে জানাজায় বুদ্ধের মৃত্যুর পরে তাঁর শিষ্য খেম বুদ্ধের দাঁত নিয়ে কলিঙ্গ উৎকলের কোনো এক স্থানে দন্ত বোন নামক স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। অনেকেই মনেকরেন দাঁতন নামটি দন্তবন থেকে এসেছে। রাজা শশাঙ্কর আমলে এই অঞ্চল দন্ডভুক্তি নামক প্রশাসনিক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। অনেকে মোনে করেন দাঁতন নামটি দণ্ডভুক্তির অপভ্রংশো। যদিও এগুলি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে।
কিভাবে যাবেন :-কলকাতা থেকে খড়্গপুর হোয়ে মোগলমারী 176কিলোমিটার পথ, চার ঘন্টার মতো সময় লাগে। বেলদা রেলস্টেশন থেকে মোগলমারী বৌদ্ধ মহাবিহারের দুরুত্ব 13কিলোমিটার। মোগলমারী বাসস্ট্যান্ড থেকে বৌদ্ধ মহাবিহার দু মিনিটের পথ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন