রহস্যময় রূপকুন্ড
ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশ শাসনাধীন। কয়েক জন ব্রিটিশ পর্বতআরোহী গেছেন গাড়োয়াল হিমালয়ের কোনো দুর্গম পর্বত অভিযানে। সেখানে গিয়ে তাঁরা প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের স্বমুখীন হয়ে হিমালয়ের এক গিরিকন্দরে এক লেকের পাশে এসে পৌঁছলেন। তাঁরা অবাক হয়ে দেখলেন লেকের মধ্যে অনেক মানুষের কঙ্কাল , তাদের ব্যাবহার করা জিনিস পত্র সব পড়ে আছে। তাঁরা ফিরে এসে তাদের বইতে সেই লেকের কথা লিখলেন। সেই লেখা পড়ে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের বিভন্ন জায়গা থেকে অনেক অভিযান হয়েছিল। পরবর্তী কালে যে লেক আমাদের কাছে রূপকুন্ড নামে পরিচিত হয়।
হিমালয়ের রূপকুন্ড সম্মন্ধে বোলতে গেলে শুধু একটা ট্রেক রুটের গল্প যদি বলে দিই তাহলে লেখা টা সম্পূর্ণ হবে না আর এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহানি, গাড়োয়ালি রসা, পথের গাইড দের মুখ থেকে সোনা গল্প ও কয়েকশো বছর ধরে চলে আসা হিমালয়ের অধিবাসী দের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় যাত্রা । রসা হলো বছর বছর ধোরে চলে আসা যাত্রা পালার মোত, ঠিক যেমন আমাদের ছোট বেলায় সোনা রাম যাত্রার গল্প।
প্রতি বারো বছর অন্তর হিমালয়ের কোনো না কোনো স্থানে জন্ম হয় চার সিং বিশিস্ট এক ভেড়ার। লোক মুখে খবর হয়ে যায় সমগ্র হিমালয়ে। চলে নন্দা যাত্রার প্রস্তুতি। নন্দা যাত্রা হলো ভারত বর্ষের এক অতি প্রাচীন ও দুর্গম ধর্মীয় যাত্রা। ভারত বর্ষের বহু রাজ রাজারাও এই ধর্মীয় যাত্রায় অংশগ্রহণ করেছেন। সেই চার সিং বিশিস্ট ভেড়াকে নিয়ে গাড়োয়ালের নৈটিয়াল গ্রাম থেকে নন্দা যাত্রার হয় শুরু। ভেড়াকে সামনে রেখে পিছনে মা নন্দার ডোলি ও সয়ে সয়ে লোকজন ঢাক ঢোল সিঙ্গা বাজিয়ে চলে নন্দা যাত্রায়। হিমালয়ের প্রতন্ত জায়গা থেকে বহু পুরুষ, মহিলা এসে যোগ দেন এই যাত্রায়। এই দুর্গম পদ যাত্রায় যারা শেষ পর্যন্ত যেতে পারেন তাঁরা গ্রামে ফিরে ভগবানের মোত পূজিত হন। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে নন্দা যাত্রার ডোলি এসে পৌঁছায় ওয়ান গ্রামে সেখানে লাটু মহারাজের মন্দিরে পুজো হয়, সেখান থেকে বৈদিনী বুগিয়াল এ মা নন্দার মন্দিরে পুজোপাঠ করে কৈলুবিনায়ক পাস হয়ে রূপকুন্ড। রূপকুন্ড পেরিয়ে ভয়ঙ্কর জিউনরা গলি পাস অতিক্রম করে শৈলসমুদ্র হিমবাহ সেখান থেকে ঘিউঠাপ্পন, হোমকুনী হয়ে পৌঁছায় হোমকুন্ডে।সেখানে এক পাথরের বেদিতে মা নন্দার পুজোপাঠ করে ভেড়া কে ছেড়ে দেওয়া হয় সেখানে। পরবর্তী কালে সেই ভেড়া কে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। একে বলে বড়া নন্দা যাত্রা।সমগ্র হিমালয় জুড়েই দেবাদিদেব মহাদেব ও মা নন্দা অৰ্থাৎ মা দুর্গার লীলা ক্ষেত্র। এর পরে মনে প্রশ্ন আসতে পারে নন্দা যাত্রাটা কোথাথেকে এল?
হিমালয়ের অধিবাসী দের পৌরাণিক ধর্ম বিশ্বাস হলো , একবার মা চলেছেন কৈলাসে, মহাদেবের সাক্ষাৎ প্রার্থী হয়ে । পথ খুবই দুর্গম, নদী, নালা, পাহাড় পর্বত পেরিয়ে নীল গঙ্গার কাছে পথ হারিয়ে ফেলেন। পথ হারিয়ে মা লাটু মহারাজের শরণাপন্ন হন। লাটু মহারাজ মাকে পথ দেখাতে রাজি হন। এদিকে দুর্গম পর্বত দিয়ে চলতে চলতে মা ক্লান্ত হোয়ে এক জায়গায় বসেপড়েন। এখানেই সমস্ত উপাচার জোগাড় কোরে হোম কোরে মহাদেবের ধ্যানে বসেন। মহাদেবের আসন গেলো টলে , তিনি উপস্থিত হলেন মার কাছে এবং তাঁকে কৈলাসে নিয়ে গেলেন। মা নন্দা যেখানে বোসে হোম করেছিলেন তাহাই আজকে হোম কুন্ড নামে পরিচিত। হোম কুন্ড হোলো হিমালয়েএর প্রাচীন এক তীর্থ ক্ষেত্র।হোম কুন্ড যাবার পথে মা নন্দা রূপকুন্ডের জলে নিজের মুখ দেখেছিলেন তাই ঐ কুন্ডের নাম হয় রূপকুন্ড। এ সব গল্প স্থানীয় লোকজন ও গাইড দের থেকে সোনা। যে জায়গায় যাচ্ছি সেখানকার ইতিহাস যদি জানা না যায় তাহলে ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না। আমরা যাবো রূপকুন্ড পর্যন্ত। রূপকুন্ডে একসাথে এতো মানুষের কঙ্কাল কোথা থেকে এল? এ প্রসঙ্গে পরে আসছি।
2004এর 19শে সেপ্টেম্বর ,জনাই এর গ্রীন ভ্যালি মাউন্টেন লাভার্স এর ছয় জন সদস্য জনাই স্কুলের মাস্টার মশাই নিখিল ঘোষের নেতৃত্বে অসংখ্য শুভানুধ্যায়ীর শুভেচ্ছা নিয়ে হাওড়া থেকে অমৃতসর মেলে চেপে বসলাম। 20শে সেপ্টেম্বর বিকাল চারটায় লকনৌ সেখান থেকে রাত নটার নৈনি এক্সপ্রেস চেপে পরদিন সকাল ছটায় লালকুয়া স্টেশনে নামলাম। পাশেই জীপ স্ট্যান্ড, সেখান থেকে সুমো ভাড়া করা হলো 239কিলোমিটার দূরবর্তী লোহারজঙ্গ পাস পর্যন্ত।
আজ বাইসে সেপ্টেম্বর সকাল ছটায় আমার তৈরি হয়ে নিলাম পথে নামার জন্যে। গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগম এর রেস্ট হাউসের সামনের বাগানে ফুটে আছে কত রঙের ফুল, অৰ্কিড। এর ঠিক পিছনেই ঘন সবুজ পাহাড় টির পিছনে উঁকি দিচ্ছে বরফ মুকুট পরিহিতা শ্বেতশুভ্র নন্দাঘুন্টি। গাড়োয়াল কুমাউন এর আদিবাসীরা নন্দাঘুন্টিকে মা নন্দা ও ত্রিশুল পাহাড়কে মহাদেব হিসেবে পুজো করেন। প্রতি বছর রাধাস্টুমীর দিন অৰ্থাৎ মা নন্দা ও শিবের বিবাহবার্ষিকীর দিন বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে মা নন্দার ডোলি এসে পৌঁছায় ওয়ান গ্রামের লাটু মহারাজ এর মন্দির প্রাঙ্গনে। সেখানে বিরাট মেলা বসে, বছরের মধ্যে একদিনই লাটু মহারাজের মন্দিরের দরজা খোলা হয়। গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বনিতা এই মেলায় অংশগ্রহন করেন। নাচ গান যাত্রাপালা চলে বহু রাত ওবধি। মা নন্দার ডোলি ওয়ান পেরিয়ে পৌঁছায় বৈদিনী বুগিয়ালে সেখানে বৈদিনী কুন্ডের ধারে মা নন্দার মন্দিরে পুজোপাঠ কোরে এই যাত্রার শেষ হয় একে বলে ছোট নন্দা যাত্রা।
গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের বাংলোর পিছনে একটু ওপর দিকে মা নন্দা ও শিবের মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রসাদ খেয়ে শুরু হলো আমাদের প্রথম দিনের পদযাত্রা। পথ প্রায় সমতল তাই আমাদের হাঁটার গতিও বেশ ভালো। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পরে পথের ডানদিকে অনেকটা নিচে একটা গ্রামের দেখা পাওয়া গেলো গাইড বললো গ্রামটির নাম বাঙ্গ। পথের ধারে ফুলের মেলা বসে গেছে, পেরিয়ে যেতে হলো পথের ওপর দিয়ে বয়ে চলা বেশ কয়েকটি ঝর্ণা। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি কেমনযেন ঘোলা ঘোলা ভাব, দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকলো। দুই ঘন্টায় ছয় কিলোমিটার পথ পেরিয়ে যখন কুলিঙ গ্রামে পৌছালাম তখন বৃষ্টি শুরু হোয়ে গেছে। তারাতারি পথের পাশে চায়ের দোকানে ঢুকে চায়ের অর্ডার দেয়া হলো কুলিঙ থেকে বাঁদিকের চওড়া রাস্তাটি কৈলাস নগর হলো ওয়ান গ্রাম গেছে। কৈলাস নগর থেকে ওয়ান এর দূরত্ব দুই কিলোমিটার। কৈলাস নগর পর্যন্ত জীপ চলাচল করে। বৃষ্টি থামতে আমরা চললাম কুলিঙ থেকে ডানদিকের উৎরাই পথে। স্কুল বাড়ি টাকে বাঁদিকে ফেলে আমরা নেমেই চলি জঙ্গলের পথে, প্রচন্ড উৎরাই পথ শরীরের ভারসাম্য রাখাই দায়। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নেমে চলেছি। বিশাল বিশাল মহীরুহ দারা প্রায় অন্ধকারাচ্ছন পথে হাঁটতে হাঁটতে মন যখন ক্লান্ত ঠিক তখন এক রাস্তার বাঁক ঘুরেই চোখ ও মনের সামনে ভীষণ ভাবে উদ্ভাসিত নীলগঙ্গা, ভীমবেগে বয়ে চলেছে।i বাঁদিকের গগনচুম্বী পাহাড়টার ওপর থেকে বিশাল আকৃতির এক কল্লোলিনী ঝর্ণা ধাপে ধাপে মনের আনন্দে নাচতে নাচতে এসে ঝাঁপ দিয়েছে নীলগঙ্গার বুকে। তার বিপুল জলরাশির গম্ভীর নিনাদে কান পাতা দায়। আমরা নীলগঙ্গার ওপর ব্রিজ পেরিয়ে প্লাষ্টিক বিছিয়ে বসে পড়লাম দুপুরের আহারে। এর পরে শুরু হলো দিদনার চড়াই পথের। প্রচন্ড চড়াইএ পা টেনে ধরে, এর মধ্যে শুরু হোয়ে গেলো বৃষ্টি। পথের পাশে ধাপে ধাপে হোয়ে রয়েছে রামাদানার চাষ, তাদের গায়ের টকটকে লাল রঙ নজর ফেরাতে দেয় না। অবশেষে কাক ভেজা হোয়ে দুপুর দুটোর সময় এসে পৌঁছলাম দিদনা গ্রামে। প্রায় গোটা পনেরো বাড়ি নিয়ে দিদনা গ্রাম। বাড়িগুলির পাথরের দেওয়াল আর স্লেট পাথরের চাল। চাষ বাস আর পশু পালন হোলো এদের জীবিকা। আমরা উঠলাম পরিত্যক্ত স্কুল বাড়িতে, এটায় এখন স্কুল বসে না চারিদিকে গবাদি পশুর বিষ্ঠা। কোনো রখমে পরিস্কার করে এটাকে আমাদের রাতের আস্থানা বানিয়ে ফেলা হোলো। বৃষ্টির গতি ক্রমশ বেড়েই চলেছে, নিচের উপত্যকা থেকে সাদা মেঘ এসে সব ঢেকে দিলো। পরদিন সকালেও একই ভাবে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। সকাল আটটার সময় বৃষ্টির বেগ একটু কমলো। দলনেতার নির্দেশে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম রাস্তায় নেমে পড়লাম। মাথায় প্লাস্টিকের টোকা লাগিয়ে হাঁটার খুব অসুবিধা হচ্ছিলো তার ওপর বৃষ্টির বেগও গেলো বেড়ে । প্রানান্ত কর চড়াই ভেঙে কেবল ওপরে উঠে চলেছি। জুতো ভিজে জবজবে হোয়ে গেছে। রোবোটের মোতো কেবল উঠে চলেছি হাপরের মোতো শ্বাস নিয়ে চলেছি। এই ভাবে প্রায় তিন কিলোমিটার চলার পরে একটা গ্রামের মধ্যে এসে পৌঁছলাম, গ্রামটির নাম তোলপানি। মখমলি সবুজ পাহাড়ের ঢালে তিন চারটি বাড়ি নিয়ে তোলপানি গ্রাম। ধাপ চাষের জমি গুলি সবুজ ফসলে ভরা। ইতি মধ্যে বৃষ্টি বন্ধ হোয়ে আকাশের একটা কোন অপার্থিব নীল রঙে নিজেকে রাঙিয়েছে। এখানে আমাদের ট্রি ব্রেক দেয়া হোলো। গাইড সুরেশ তাড়াতাড়ি গরম চা নিয়ে হাজির। গরম চায়ের কাপে শরীর আবার চাঙ্গা। স্যাক তুলে আবার শুরু হলো চড়াই পথ বেয়ে উঠে যাওয়া। বিশাল বিশাল মহীরুহ আচ্ছাদিত প্রায় অণ্ধকার পথ। অনন্ত একঘেয়ে চড়াই পথে হাঁটতে হাঁটতে কারোর মুখেই কোনো কথা নেই। ক্লান্ত হলো পথের পাশে বসে পড়ে আমাদের দুই কিশোর মালবাহক রমেশ আর ক রণ। তাঁদের কচি কচি সাদা মুখ দুটি লাল হয়ে গেছে। পথের পাশে বিছুটি আর কাঁটা ঝোপের ঝাড়। কাঁটা ঝোপে স্যাক আটকে যায়। এই ভাবে প্রায় চার কিলোমিটার হাঁটার পরে বড়ো বড়ো গাছের জঙ্গল শেষ হোয়ে সামনের রাস্তা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছোট ছোট টিলা পাহাড়ের মাথা থেকে সবুজ মখমলি ঘাসের ঢাল গড়াতে গড়াতে অতি প্রাচীন বৃক্ষগুলির পদ প্রান্তে এসে শেষ হয়েছে। আমরা একটা গাছের ছাওয়া দেখে বসে পড়লাম দুপুরের আহারে। তোলপানির পরে বৈদিনী বুগিয়ালের আগে কোথাও জল পাওয়া যাবে না তাই জল সঙ্গে করে আনতে হয়েছে। আহার সম্পন্ন করে যে যার স্যাক তুলে নিলাম, আমরা এসে গেছি গাড়োয়াল সুন্দরী আলী বুগিয়াল এর দরজায়। মখমলি সবুজ ঘাসের মাঠ সোজা উঠে গেছে টিলার মাথায় সেখান থেকে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় তার বিস্তার। পথ ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গেছে, এর পর আবার কিছুটা সবুজ মাঠ আবার টিলা আর তাতে ফুটে রয়েছে কত যে রঙবে রঙের ফুল তা গুনে শেষ করা যাবেনা। প্রতি পদক্ষেপেই মাড়িয়ে ফেলতে হোচ্ছে সুন্দর সুন্দর ফুল। সবুজের যে কতো প্রকার রঙ হতে পারে এখানে আসার আগে জানতাম না। পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষের মনের কতো পরিবর্তন হয়, এখন সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে, আমাদের দুই মালবাহক সবুজ ঘাসে ডিকবাজি খেতে শুরু করলো আর আমাদের টিম ক্যাপ্টেন মাথা ঘাসের ওপর রেখে পুরো শরীর টাকে সোজা করে ওপর দিকে তুলে দিলো। আলী বুগিয়াল প্রতি পদক্ষেপেই বিস্ময়কর সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে আমাদের সামনে হাজির। খুব ইচ্ছে হোলো এখানে একদিন থাকবো, কিন্তু গাইড বললো এখানে জল পাওয়া যাবে না তাই অনিচ্ছা স্বর্তেও এগিয়ে যেতে হোলো। হৃদয় কলস পূর্ণ কোরে আলী বুগিয়াল এর মধ্যে দিয়ে প্রায় ছয় কিলোমিটার পথ পেরিয়ে যখন বৈদিনী বুগিয়াল প্রবেশ করলাম তখন ত্রিশুলের মাথা থেকে একটু একটু কোরে মেঘ সরতে শুরু করেছে। সকাল নয়টায় দিদনা থেকে যাত্রা কোরে আমরা বৈদিনী বুগিয়াল পৌছালাম বিকাল ছটায়। পৌছিয়ে পাথরের দেওয়াল ঘাসের চাল ওলা ঘরের দখল নিলাম। ঘাসের চালের ওপরে চাপিয়ে দেয়া হোলো সঙ্গে নিয়ে যাওয়া তাঁবুর আউটার আর মাটির মেঝেতে প্লাষ্টিক পেতে মোটামুটি থাকার উপযোগী কোরে তোলা হোলো। উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাওনোর জন্য বৈদিনীতে (12000ft)আমরা আরো একদিন থাকবো। পরের দিন আবহাওয়া খুব পরিষ্কার। ঘরের বাইরে এসে আমরা অভিভূত, ঘন নীল আকাশের বুকে একদিকে ত্রিশুল (23350, 21940, 20240ft)ও নন্দাঘুঁটি (20800ft)অন্য দিকে নীলকণ্ঠ (21640ft ), কেদারনাথ (22800ft), চৌখাম্বা (23420, 23180, 22870, 22500ft ), হাতি পর্বত (22370ft), গৌরী পর্বত (22030ft )ঝগ ঝগ করছে। বৈদিনী কুন্ডের জলে নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশূল পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। বুগিয়ালের একপাশে বৈদিনী কুন্ড এখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে নীলগঙ্গার। কুন্ডের পাশেই মা নন্দার মন্দির। আমরা মা নন্দার মন্দিরে পুজো দিয়ে আশপাশের পাহাড় গুলিতে উঠতে শুরু করলাম। পাহাড়ে উঠেতো আমরা অবাক, কতো রকমের ফুল ফুটে আছে, মৌমাছিরা মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে আর কতো রংবেরঙের প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে ফুল থেকে ফুলে। আমরা শুরু করলাম এই উচ্চতায় এই অপরূপ দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করতে। আসতে আসতে সূর্য চলেছে অস্তাচলে আর ত্রিশুলের বুকে শুরু হোলো রঙের খেলা, এ দৃশ্য বহু দিন ভুলতে পারবোনা। পরদিন ভোর চারটে থেকে আমাদের ঘর জেগেকারণ ছটার মধ্যে আমাদের বেরোতেই হবে। প্রাতঃক্রিয়া ও খাওয়া দাওয়া কোরে বেরোতে বেরোতে ছটাই বেজে গেলো। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি ত্রিশুলের ঠিক উল্টো দিকে নীলকণ্ঠ, কেদারনাথ, চৌখাম্বা, হাতি পর্বত, গৌরী পর্বত ধীরে লাল হতে শুরু করেছে। বৈদিনীতে এসে অপরূপ সূজাস্ত্র ও সূয্যদ্বয়ের সাক্ষী হোলাম। বৈদিনী কুন্ডের পাস দিয়ে রাস্তা ওপরের দিকে উঠে গেছে। ফুলের রাজ্যের মধ্যে দিয়ে আমরা উঠে চলেছি। অনিচ্ছা শর্তেও মাড়িয়ে যেতে হোচ্ছে ভগবানের এই বিশ্বয়কর সৃষ্টিদের। ক্রমশ ওপরের দিকে উঠে চলেছি আর চোখের সামনে ভেসে উঠছে একের পর এক তুষার মুকুট পরিহিত পর্বত শৃঙ্গ। সূর্য উঠে চারিদিক আলোকিত করেছে কিন্তু আমরা যে পাহাড় টা দিয়ে উঠে চলেছি তার পশ্চিম গাত্র এখনো অণ্ধকার তাই ঠান্ডাও খুব বেশি। বৈদিনী থেকে শুরু করেছি প্রায় এক ঘন্টা হবে এখনও রোদের মুখ দেখিনি। একটার পর একটা রিজ পেরিয়ে চলেছি। এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম পঞ্চাশ ফুটের মোতো পাহাড়ের মাথা টা কাটা আর সেখান দিয়ে বন্যার জলের মোতো আলো এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে পাহাড়টির পশ্চিমের নিচের উপত্যকা কে। অণ্ধকার ও ঠান্ডার মধ্যে দিয়ে আসতে আসতে এমন মিষ্টি রোদ দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না, বসে পড়লাম বিশ্রামের জন্য। সামনের দিকে তাকিয়েতো বিশ্বয়ের ঘোর কাটেনা। আমার সোজাসুজি হাতি পর্বত, দেখতে অবিকল হাতির মোতো। সামনের দিকে শুঁড়, শুঁড়ের শেষে মাথা একদম হাতির মোতো। শিরদাড়া চলে গেছে লেজের দিকে, পেট থেকে পিছনের একটি পা বেঁকে কিছুটা দৌড়এর ভঙ্গিতে নেমে এসেছে আর সামনের দুটি পা সোজাসুজি নেমেছে। বৈদিনী থেকে হাতি পর্বত দেখা গেলেও হাতির অব্যয়ব এতো স্পষ্ট বোঝা যায় না।
আমরা চলেছি নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশুলের দিকে। একটার পর একটা রিজ পেরিয়ে চলেছি, মনে হচ্চে আর একটা পাহাড় টপকালেই বুজি নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশুলের পায়ের কাছে পৌঁছে যাবো। একটা পাহাড় শেষ করছিতো নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশূল মরীচিকার মোতো দূরে চলে যেতে থাকলো। অবশেষে এসে পৌছালাম পাথরনাচনিতে। বৈদিনী থেকে সকাল ছয়টার সময় যাত্রা কোরে পাথরনাচনি এসে পৌঁছলাম সাড়ে দশটায়। যে দিকে চোখ যায় শুধু সবুজ কার্পেটে মোড়া পাহাড়, যে যার স্যাক নামিয়ে মখমলি সবুজ ঘাসের কার্পেটে শরীর এলিয়ে দিলাম। ব্যাবস্তা করা হোলো জলখাবারের, খেতে শুরু করেছি তখন গাইড সুরেশ শুরু করলো গল্প।
কনৌজ রাজ জোসোয়াল সিং চলেছেন মা নন্দার হোম কুন্ডে। রানী বল্লভা অন্তঃসত্ত্বা তবু তিনি নাছোড় বান্দা, তিনিও যাবেন রাজার সঙ্গে। বাধ্য হোয়ে রাজা মত দিলেন রাজা চলেছেন তার সঙ্গে চলেছে রাজ পরিবারের লোক জোন, সাধুসন্থ, সৈন্য বাহিনী, মন্ত্রী, মহিলা পুরুষ শিশু প্রজার দল এমনকি রংমহলের নর্তকীরাও। স্থানীয় আদিবাসী দের নেওয়া হয়েছে মালবাহক হিসেবে। তাঁবু ফেলা হোচ্ছে আর চলছে মহা ভোজ। নর্তকীরাও হিমালয়ের সৌন্দর্যে পাগলপারা। তারাও মনের আনন্দে নাচ আর গানের তুফান তুলছে রাতের তাঁবুতে। দিনের পর দিন কেটে যায় রাজা মশগুল হোয়ে থাকে তার নর্তকীদের নাচে। এমন সময় এক রাতে মানন্দা রাজাকে স্বপ্ন দিলেন। তুই কিনা আমার দর্শনে চলেছিস আর আমার কথা ভুলে গিয়ে প্রমোদে মত্ত হয়েছিস। রাজার সম্বিৎ ফিরে আসে। মন্ত্রীকে ডেকে মাঝরাতে তার কাজ বুঝিযে দেয়। তখনো ভোর হয়নি, পাখিরাও ডেকে ওঠেনি, মন্ত্রী নর্তকীদের তাঁবুতে যায় তাদের ডেকে নিয়ে আসে পাথর নাচনি তে। তাঁরা কিছু বোঝার আগেই সেখানে তাদের জ্যান্ত কবর দেয়া হোলো। তাদের আর্তনাদ পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে ঘুমন্ত পাহাড়ের নিস্তব্ধতাকে খান খান কোরে দিলো। সুরেশ তিনটি গর্ত দেখিয়ে বললো এই হোলো তিন নর্তকীর কবর। এতো সুন্দর জায়গায় এমন একটা গল্প শুনে মনটা কেমন যেন গুমোট হোয়ে গেল।
আমরা যে যার স্যাক পিঠে তুলে নিলাম সামনেই কৌলুবিনায়ক এর চড়াই পথ। নিচে থেকে পুরো পথই দেখা যাচ্ছে। ইংরেজি z অক্ষর এর মোতো রাস্তা উঠে গেছে এক গগন চুম্বি পাহাড়ের মাথায়। পথের দৃশ্য কিন্তু মনোরম। সবুজ মখমলি ঘাসের পাহাড় গুলিকে সাদা মেঘ এসে ঢেকে দিতে থাকলো। ভয় হয় বুঝি বৃষ্টি শুরু হোলো। চড়াই পথ শেষ হয়ে শুরু হোলো সরু পাথুরে খাড়াই সিড়ি। পথের দুই পাশে শুরুহলো পদ্ম পাতার মোতো দেখতে লাল পাতার এক ধরণের এক গাছের, দূর থেকে লাল ফুলের গাছ বলে ভ্রম হয়। বেশ কিছুটা চলার পরে বিক্ষিপ্ত ভাবে দেখা যেতে থাকলো ব্রম্ভ কমলের গাছ কিণ্তু তাতে ফুল নেই। আমরা যখন কাঠগুদাম থেকে লোহারজং এর পথে তখন এই অঞ্চলে প্রচুর তুষার পাত হয়, তুষারের আঘাতে
ব্রম্ভ কমলের মোতো কোমল ফুল নষ্ট হোয়ে গেছে। এছাড়া আমরা যেদিন ট্রেকিং শুরু করি সেদিন ছোট নন্দা যাত্রার শেষ দিন ছিলো, কাজেই সেখানকার অধিবাসীরা পথের ধারে ফুটে থাকা ফুল তুলে বৈদিনীতে মা নন্দার পুজো দিয়েছেন। একটার পর একটা চড়াই পথ শেষ কোরে অবশেষে উঠে এলাম কৈলুবিনয়াকএ। পাথর নাচনি থেকে এগারোটার সময় শুরু কোরে কৈলুবিনায়ক
এসে পৌঁছলাম দুপুর একটায়। একটা উঁচু রিজের মাথা হোলো কৈলুবিনায়ক। একদিকে নেমে গেছে বড়ো বড়ো কালো পাথর বিছানো উপত্যাকা আর একদিকে পাথর নাচনি থেকে উঠে এসেছে খাড়া চড়াই রাস্তা। যেদিকে চোখ যায় শুধু প্রকৃতির ব্যাপক ধ্বংস লীলা, বড়ো বড়ো রুক্ষ পাহাড়গুলি ফেটে চৌচির হোয়ে গেছে আর তাদের দেহবসিষ্ট ছড়িয়ে পড়ে সৃষ্টি করেছে এক ভয়ঙ্কর দর্শন উপত্যাকার। কৈলুবিনায়ক পাসের মাথায় পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে তৈরী ছোট্ট মন্দির আর তাতে অৰ্ধ সোয়িত কষ্টি পাথরের গণেশ মূর্তি, রয়েছে বড়ো বড়ো পেতলের ঘন্টা। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া পৈতা ও চেলি পরিয়ে ধূপ বাতি জ্বালিয়ে পূজা সমাপন কোরে যে যার স্যাক পিঠে তুলে নিলাম। আমাদের পথ ডানদিকে নেমে গেছে। বেশ কিছুটা যাবার পর পথের ঠিক পাশেই ডানদিকে বড়ো হ্যাংওভারের সামনে পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে দুটি গুহা। মেরে কেটে চার পাঁচ জন থাকতে পারবে। রূপকুন্ড রহস্য উদ্ঘাটনে এসে স্বামী প্রণবানন্দ এই গুহায় ছিলেন। আমরা আরো কিছুটা অর্থাৎ মিনিট কুড়ি এগিয়ে গিয়ে রানী কিসুডেলা তে রাত কাটাবো। আমাদের গাইড ও মালবাহকরা আগেই একটা পাথরের ঘরের দখল নিয়েছে। পাথরের ওপরে পাথর সাজিয়ে দেওয়াল তার ওপরে কাঠের বিম, বিমের ওপরে স্লেট পাথরের চাল। ঘরের এমন উচ্চতা যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হবে। মেঝে কোথাও ছয় ইঞ্চি উঁচু কোথাও ছয় ইঞ্চি নিচু। আমরা এসে দেখি সুরেশ চায়ের জল বসিয়ে দিয়েছে। গরম চায়ের কাপে শরীর আবার চাঙ্গা। আমরা বেরিয়ে পড়লাম ব্রম্ভ কমলের খোঁজে। ফেটে চৌচির হোয়ে যাওয়া রুক্ষ পাহাড়ের গা বেয়ে কেবল উপরের দিকে উঠে চললাম। বেশ কিছুটা ওঠার পরেই দেখি জায়গায় জায়গায় পাথরের খাঁজ থেকে বেরিয়ে সেই বহু আকাঙ্খিত ফুল। আমরা দ্বিগুন উৎসাহে ওপরের দিকে উঠতে থাকলাম আর বাড়তে থাকলো ফুলের ঘনত্ব। স্বর্গের নন্দন কাননে অতি সাবধানে পা ফেলতে হয় না হোলে পদদলিত হবে এই অদ্ভুত সুন্দরেরা। আমরা নিচে নেমে এলাম। এখানে সবসময় একটা হওয়া চলছে তাই ঠান্ডা টাও বেশি। আমরা টেন্ট পিচে ম্যাট্রেস পেতে রোদের ওম নিতে শুরু করেছি হটাৎ সাদা মেঘ এসে ঢেকে দিলো সূর্যকে। মেঘ ও সূর্যের লুকোচুরি খেলা বেশ কিছুক্ষন চললো। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামলো। ঘরের মধ্যে টিমটিমে মোমের আলোয় সুরেশের খিচুড়ি রেডি। আহার সেরে স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে কোনোরখমে নয় জন গাদাগাদি কোরে বোসে বোসে ঘুমানো। এই উচ্চতায় এমনিতেই ভালো ঘুম হয়না তার ওপর এই ভাবে। গাইড সুরেশ শুরু করলো গল্প।
কৈলু বিনায়কের চড়াই শেষ কোরে রাজা তার দলবল নিয়ে এসে পৌছালো রানী কি সুডেলায়। এদিকে অন্তসত্তা রানীর প্রসব যন্ত্রনা শুরু হোলো। তিনি এখানে দুটি শিশুর জন্ম দিলেন। এদিকে মা নন্দা তো রেগে আগুন। রানী কিনা দেবাদিদেব মহাদেবের জায়গা কলুষিত করেছেন। তিনি সমস্ত দেবতাদের কাছে যান আর বলেন এর বিহিত করতে হবে। কোনো দেবতাই তার কথায় কর্ণপাত করেন না। তখন তিনি ওয়ান গ্রামের লাটু মহারাজের দ্বারস্থ হন। লাটু মহারাজ হলেন ঝড়, বৃষ্টি, তুফান, অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টির দেবতা। জমিতে ফসল হওয়া, না হওয়া তার ওপর নির্ভর করে। তাই বিপদে পড়লেই ওয়ান এর আদিবাসীরা লাটুমহারাজের মন্দিরে যান এবং সেখানে ভেট চরান। লাটু মহারাজ দেবীকে সাহায্য করতে রাজি হলেন শর্ত সাপেক্ষে। যে কৈলাসে দেবাদিদেব ও তার দর্শনে যখন ভক্তকুল যাবে যেন তাকে দর্শন করে তবে যেতে পারে । তাঁকে কৈলাসের দ্বার রক্ষী বানাতে হবে। দেবী রাজি হলেন তার শর্তে। হটাৎ প্রচন্ড তুফান উঠলো রানী কি সুডেলায় আর সেই তুফানে রানী ও তার শিশু সন্তানেরা উড়ে গিয়ে নিচের উপতকায় পড়লো আর পাথর হোয়ে গেলো। সুরেশের গল্প শেষ আমরা ঘুমের দেশে পারি দিলাম।
রাত প্রায় দেড়টা সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন, পূর্ণিমার চাঁদের আলো পাথরের চালের ফুটো দিয়ে ঘরের মধ্যে পড়েছে তখন আর বাইরে বেরোনোর লোভ সামলাতে পারলাম না। স্লিপিং ব্যাগ টোপকে টোপকে কোনোরখমে দরজার সামনে প্লাস্টিক সরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যেই বাইরে বেড়িয়েছি দেখি আমাদের ঘর থেকে প্রায় পনেরো ফুট দূরে দশ বারো জোড়া চোখ জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে পকেট থেকে টর্চ বের করে চোখ গুলির দিকে জেলে ধরলাম আর অবাক হোয়ে দেখলাম হিমালয়ের বিরল দর্শন হরিণ যাকে এই অঞ্চলের অধিবাসীরা বোড়াল বলে। টর্চের আলো পড়তেই তারা হেলতে দুলতে পাসের পাথর গুলির আড়ালে অদৃশ হোয়ে গেলো। আর আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে তো অবাক। জোস্নায় চরাচর ভেসে যাচ্ছে, কালো কালো দৈত্যকার পাহাড় গুলি বড়োই শান্ত, রক ফল জোন দিয়ে নেমে আসা বিকৃত দর্শন পাথর গুলি গভীর ঘুমে মগ্ন আর এর ঠিক পিছনেই মা নন্দা তুষার সজ্জা পরিহিত কোমল মুখখানি নিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব ত্রিশুলের সাথে যুগ যুগ ধোরে মনের কথা বলে চলেছেন। আর রাতের নক্ষত্র গুলি ফুল হোয়ে এই স্বর্গের নন্দনকানন ভরিয়ে রেখেছে। মা নন্দার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হোয়ে কতক্ষন বাইরে বসেছিলাম মনে নেই, হটাৎ হিমেল হওয়ার স্পর্শে যখন ঘরে ঢোকার প্রয়োজন অনুভব করলাম তখন ঘড়িতে দুটো বাজে। পরদিন ভোর চারটেয় উঠতে হবে তাই ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে গেলাম।
সুরেশের ডাকাডাকিতে যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি চারটে বাজে। মোমের মৃদু আলোতে আমাদের ঘর জেগে। সুরেশ স্টোভেতে চা এর জল বসিয়ে দিয়েছে, রমেশ ও কর্ণ আমাদের রুটি তৈরী তে ব্যাস্ত, অশীত দা জলে জিওলিন দিচ্ছে, সুকান্ত ক্যামেরা ঠিক করছে, বাপ্পাদিত্য সবাইকে টিসু পেপার দিচ্ছে, পল্লব ওষুধ পত্র গুছিয়ে নিচ্ছে আর আমাদের ক্যাপ্টেন জানাই স্কুলের মাস্টারমশাই নিখিল ঘোষ গম্ভীর ভাবে ম্যাপের দিকে তাকিয়ে বোসে আছেন।
মা নন্দার নামে জয়োধ্বনি দিয়ে পথে নামতে নামতে আমাদের প্রায় ছটা বেজে গেলো। পথ প্রথমে হুনিয়াথর পর্যন্ত প্রায় সমতল। প্রভাতী সূর্যের আভা বড়ো বড়ো পাহাড়ের বাধা টোপকে আমাদের আজকের পথ সম্মন্ধে ওয়াকি বহাল করছে। ইংরেজি z অক্ষরের মোতো পথ কেবল ওপরে উঠে গেছে। নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশুলের মাথায় আলো এসে পড়েছে। গোয়ালদাম থেকে দেখা ত্রিশুলের সামনে কালো পাহাড় টার নাম কালাডাক, কালাডাক এখন বাঁদিকে সরে গেছে। চোখের সামনে উদ্ভাসিত ত্রিশুল 1ও 2, তিন নাম্বার পিকটিকে ডানদিকের কালো পাহাড়টি আড়াল কোরে দিয়েছে। আমরা কেবল ত্রিশুল 2এর দিকে উঠে চলেছি। আস্তে আস্তে নন্দাঘুন্টি চোখের অড়ালে চলে গেলো। গত কদিনের বৃষ্টিতে এই অঞ্চলে এতো বরফ পড়েছে যে রূপকুন্ড যাবার রাস্তা বলে কিছু নেই সব বরফে ঢাকা। স্যার রাস্তা বানিয়ে আগে চলেছেন আর আমরা পিছনে পিছনে, গাইড সুরেশ পিছিয়ে পড়া সদস্য দের নিয়ে উঠে আসছে। আস্তে আস্তে নিচের ভয়ঙ্কর পাথর বিছানো উপত্যকা এতো নিচে চলে গেলো যে স্পষ্ট কোরে কিছুই দেখা যায় না। আমরা এমন বরফের ঢালে চলেএলাম যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে মেপে ফেলতে হোচ্ছে। একটা পা ভুল ফেলামানে বেসামাল শরীর টাকে নিয়ে হাজার হাজার ফুট নিচে নিয়ে ফেলবে। নিচের উপত্যাকার দিকে তাকানো যাচ্ছে না পাছে মাথা ঘুরে যায়। প্রচন্ড ঠান্ডায় গ্লাফস পড়া হাতের আঙ্গুল গুলি ফেটে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষন এই ভাবে ওঠার পর এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম যেখানে সুউচ্চ গিরি প্রাচির এর ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে দশ পনেরো ফুট জায়গায় পড়ছে, আমরাও বোসে পড়লাম সূর্যের ওম নিতে। শরীর স্বাবাবিক কোরে আমরা উঠে চললাম বিপদজনক তুষার ঢাল ধোরে। হঠাৎ স্যার একটু বেশি ঢালের দিকে চলে গেলেন। চার হাত পা ব্যবহার কোরে আর উঠতেও পারছেন না ফিরে আসতেও পারছেন না। আমি রয়েছি স্যারের ঠিক পিছনেই, কি করবো ভেবে ওঠার আগেই গাইড সুরেশ পিছন থেকে দৌড়ে এসে স্যারের পায়ের নিচে পা দিয়ে স্যারের শরীর টাকে সাপোর্ট দিয়ে দিলো। ওপর থেকে বর্ধমানের গ্রূপের গাইড লকপত সিং দৌড়ে এসে আইস এক্স দিয়ে স্টেপ কাটতে শুরু করলো। দুজনের সাহায্যে স্যার নিরাপদ জায়গায় চলে এল। হঠাৎ ঘটে যাওয়া বিপদে শরীরটা কেমন যেন ভারী হোয়ে গেছিলো। মন ও শরীর কে স্বাভাবিক কোরে আমরা কেবল উপর দিকে উঠে চললাম। এবার শুরু হোলো প্রচন্ড চড়াই পথের। আমরাও চোয়াল শক্ত কোরে উঠে চললাম চড়াই পথ ধোরে। বেশ কিছুটা ওঠার পর আমরা যে পাহাড় টার বুক বেয়ে উঠছিলাম তার মাথায় এসে পৌঁছলাম। এখন সামনেটা আমাদের কাছে উন্মুক্ত হোয়ে গেল, সামনেই ত্রিশ চল্লিশ ফুট বরফের ঢাল। কিছু বোঝার আগেই স্যার বুকে জড়িয়ে ধরলো, স্যারের চোখে আনন্দ অশ্রু আমরা পৌঁছে গেছি আমাদের আকাঙ্খিত জায়গায়। বরফের সমতল জায়গার ডানদিকে কিছুটা উঁচুতে দুটো স্লেট পাথরকে হেলিয়ে ত্রিভুজের মোতো কোরে মা নন্দার মন্দির। মন্দিরের পাস দিয়ে উঠে গেছে জিউনরাগল্লির খাড়া ঢাল যার একদিক এসে মিলিত হয়েছে রূপকুন্ডে। সমতল জায়গার একদিকে চাননিয়া কোট, চাননিয়া শংকর যা রূপকুন্ডের দুই দিক বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কুন্ড এখন মোটা বরফের আস্তরণে আচ্ছাদিত। আমরা ধীরে ধীরে নেমে চললাম কুন্ডের তীরে। সকাল ছটায় যাত্রা কোরে রূপকুন্ড এসে পৌছালাম আটটা পঁয়তাল্লিস মিনিটে। সূর্যের আলো আশপাশের পাহাড় গুলিকে আলোকিত করলেও এই গিরি কন্দরে এখনো এসে পৌঁছয়নি। লক পত সিং জিউনরাগল্লির উপর থেকে হাত নাড়তে নাড়তে তার দলবল নিয়ে অদৃশ্য হোয়ে গেলো তাদের গন্তব্য হোমকুন্ড।
এদিকে গাইড সুরেশ শুরু করলো তার গল্প, পথমধ্যে রানীকে হারিয়ে দলবল নিয়ে রাজা এগিয়ে চললো জিউনরাগল্লির পথে। শুরু হোলো প্রচন্ড তুষারপাত। প্রচন্ড প্রাকৃতিক দুর্যোগে জিউনরাগল্লি তার গায়ে বরফ ধোরে রাখতে পারলোনা তখন রূপকুন্ডের বুকে নেমে এল এক বিশাল তুষার ধস আর তাতেই সলিল সমাধি ঘটলো সমস্ত তীর্থযাত্রীর। এখনো অনেক কঙকাল রয়েছে রূপকুন্ডে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন