সুন্দরী অযোধ্যা পাহাড়।

কন কনে শীতের এক ভোরে পুরুলিয়া রেল লাইনের ওপর ব্রিজ পেরিয়ে পুরুলিয়া শহরে প্রবেশ কোরলাম। এর পর সিরিকাবাদ হয়ে আমাদের গাড়ি ডানদিকে ঘুরে টামনার  রাস্তায় এসে পৌঁছলো । রাস্তার পাশে ধাবার উনুনে গনগনে কাঠের আগুন ঘিরে কয়েক জোন স্থানীয় অধিবাসী, আমরাও এই শীতল ভোরে গরম গরম চা এর আশায় হানা দিলাম ধাবায়। গনগনে কাঠের আগুনে শরীর সেঁকতে সেঁকতে গরম চায়ের কাপে চুমুক। গতকাল রাত এগারোটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে  টামনা পৌঁছতে ভোর হয়ে গেলো। মাঝে রাত দুটোর সময় জয়পুরের বনলতা রিসর্টে চাপানের বিরতি দেয়া হয়েছিল। গরম চায়ের কাপে রাত জাগার ক্লান্তি কাটিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চললাম। এদিকে আস্তে আস্তে রাতের অণ্ধকার ক্ষীণ হয়ে প্রকৃতির বুকে হালকা ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের গাড়ি চকচকে পিচের রাস্তা ধোরে  উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলেছে অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে। পথের বাঁকে পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে ঘন লাল সূর্য উঠে পড়লো, যার  রক্তিম আভা সারা পাহাড় জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। পাহাড়ের গায়ে শিশির ভেজা শাল ও পলাশের  ঘন জঙ্গলে এক রখম সাদা ফুলের সমারোহ যা সমগ্র পাহাড়কে সবুজ আর সাদা রঙে রাঙিয়ে তুলেছে। এর বুক চিরে চলে গেছে কালো পিচের  পাকদন্ডী রাস্তা। পথের পাসের সাঁওতালি গ্রাম গুলি উঠছে জেগে। মাটির দেওয়াল বাড়িগুলির মাথায় সরু সরু গ্লাস টালির চাল, মাটির  দেওয়ালে রঙ দিয়ে বিভিন্ন আলপনা ও ছবি আঁকা আবার কোনো দেওয়াল গেরুয়া ও কালো রঙে রাঙানো। গ্রামের মহিলারা মাটির বাড়ির দেওয়ালে ও উঠোনে নেতা দেওয়ার কাজে ব্যাস্ত। পুরুষেরা গবাদি পশুর দল নিয়ে চলেছে পাহাড়ের চারণ ভূমিগুলির দিকে। 
শাল পলাশের জঙ্গলের মাঝ দিয়ে পাকদন্ডী পথে আমরা এসে পৌঁছলাম অযোধ্যা পাহাড়ের টপ হিলে। বেশ কয়েকটি হোটেলে ঘর ফাঁকা নেই। অনেক প্রাইভেট গাড়ি ও বাইক এসেছে অযোধ্যা ঘুরতে। আমরা টপ হিল থেকে একটু সামনের দিকে এগিয়ে মা লক্ষ্মী লজের দোতলায় জায়গা পেলাম। মা লক্ষ্মী লজ আমার পছন্দ হওয়ার কারণ এর দোতলা বারান্দা থেকে পাহাড়ের সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। হোটেলটি নতুন হয়েছে। অযোধ্যার ষ্টার হোটেল কুশলপল্লী ও ইয়ুথ হোস্টেল থেকেও ভালো ভিউ পাওয়া যায়। জায়গায় জায়গায় রয়েছে টেন্টের ব্যাবস্তা, উৎসাহীরা এখানেও থাকতেও পারবেন। 
ব্রেকফাস্টএর অর্ডার  কোরে আমরা ফ্রেশ হোয়ে নিলাম। ব্রেকফাস্ট কোরে  আমরা বেরিয়ে পড়লাম অযোধ্যা পাহাড় ঘুরে দেখতে। শাল পলাশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কালো চক চকে পিচের রাস্তা গেছে চলে। ঘন জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে কতো পাখির ডাক। পলাশের সময় অৰ্থাৎ ফেব্রুয়ারীর শেষ ও মার্চের শুরুতে এই পথের দুই পাশ পলাশে লাল হোয়ে থাকে।তখন এই অঞ্চলের হোটেলে ঘর পাওয়াই মুশকিল। আমাদের গাড়ি পিচের রাস্তা থেকে ডানদিকে নেমে  এক পরোটা আকৃতির লেকের কাছে এসে পৌঁছলো, এটির নাম মার্বেল লেক। অযোধ্যায় যখন ড্যাম তৈরী হয় তখন অনেক পাথরের প্রয়োজন হয়, তখন এখান থেকে প্রচুর পাথর কেটে নিয়ে যাওয়ার ফলে গভীর খাদের সৃষ্টি হয়, যেখানে  বর্ষার জল জমে সৃষ্টি হয়েছে এক লেকের। এর চারপাশ উঁচু  পাহাড় দিয়ে ঘেরা। আমরা যখন লেকের কাছে পৌঁছলাম তখন পাহাড়ের উপর থেকে ভেসে আসছে মাদলের নেশা ধরানো আওয়াজ যা লেকের চারপাশে প্রতিধ্বনিত হোচ্ছে। 
মার্বেল লেক দেখে আমরা নেমে চললাম বাঘ মুন্ডির   দিকে। এই নেমে চলার পথটি ভারি সুন্দর, এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে সিকিমের অথবা উত্তরাখণ্ডের চোখ জুড়ানো পাহাড়ি পথের। লোয়ার ড্যামকে পাশে ফেলে আমরা নেমে এলাম বাঘমুন্ডির সমতলভূমিতে। বিস্তৃত ধান জমির মাঝ দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। পথের দুইপাশে প্রচুর খেজুরের গাছ আর তাতে ভাঁড় বাঁধা রয়েছে, তাতে রয়েছে টাটকা খেজুরের রস। আমরা লোভ সামলাতে পারলাম না, পথের পাসের একটা গাছ থেকে এক ভাঁড় রস পেরে সবাই মিলে মজা কোরে খেলাম তার পর ভাঁড় আবার গাছে বেঁধে দিলাম । হটাৎ দেখি একটা বাচ্চা ছুটে আসছে আমাদের দিকে। সে এসে বললো এখানে রস খাবেন না এই মাত্র ভাঁড় বাঁধা হয়েছে, আমাদের বাসায় চলুন রস খায়াবো। আমরা গাড়িতে উঠে পৌঁছলাম পথের পাশের খেঁজুর পাতার ঝুপড়ি তে। গিয়ে দেখি সেখানে তখন বড়ো পাত্রে গুড় জ্বাল দেওয়া হোচ্ছে। আমরা বেশ কিছুটা পাটালি গুড় ও পাতলা গুড় কিনলাম। বাচ্ছা টি আবার আমাদের টাটকা খেজুর রস খেতে দিলো। 
 আমরা গাড়িতে উঠে চললাম চরিদা গ্রামের পথে। পথের পাশে পলাশ গাছের সমারোহ, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের পরে মাথা উঁচু কোরে অযোধ্যা পাহাড়ের রেঞ্জ আর তার সামনে জায়গায় জায়গায় খেঁজুর গাছের সারি। অদ্ভুত সুন্দর পথ দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম ছৌ নাচের মুখোশ তৈরির শিল্পীদের  গ্রাম চড়িদা গ্রামের দিকে। বাঘমুন্ডির ঘিঞ্জি মার্কেট পেরিয়ে, চরিদা ব্রিজ পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম চরিদা গ্রামে। রাস্তার দুই পাশেই লম্বা লাইন দিয়ে ছোট ছোট দোকানের সারি। দোকান গুলি বিভিন্ন রখম মুখোশ দিয়ে সাজানো, শিল্পীরা মুখোশ তৈরীতে ব্যাস্ত, চলছে দর দাম কোরে কেনাকাটা। ছৌ নাচের মুখোশ তৈরির গ্রাম চরিদা থেকে ঝালদার দিকে চললাম খয়রাবেরা ড্যামের উদ্দেশ্য। চরিদা থেকে প্রায় চার কিলোমিটার যাওয়ার পর মেন রাস্তা ডানদিকে ঘুরে কংক্রিটের  সরু রাস্তা ধোরে সাঁওতালি গ্রামের মধ্যে দিয়ে পথ।রাস্তার দুপাশের গাছ  ঝুলে পড়ে তোরণের সৃষ্টি করেছে, সামনেই অযোধ্যা পাহাড়ের উত্তুঙ্গ পাহাড় শ্রেণীর তীব্র হাতছানি। রাস্তাটা এতো সরু যে দুটি গাড়ি পাশ হতে বেশ অসুবিধা হয়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাল্টে যেতে থাকলো দৃশ্যপট। অবশেষে আমরা এসে পৌছালাম খয়রাবেরা ড্যামে। বিশাল জলাধারের চার পাশে ঘন সবুজ পাহাড়ের শ্রেণী। অপূর্ব এর সৌন্দর্য, নজর ফেরানো যায় না। ড্যামের পাশে একটি মাত্র থাকার হোটেল "ইকো এডভেঞ্চার ক্যাম্প "খয়রাবেরা  অনলাইনে বুক করতে হয়। একটি মাত্র চা এর দোকান রয়েছে ড্যামের পাশে। চা খেয়ে আমরা আশপাশটা এক্সপ্লোর করতে করতে একটা ট্রেক রুটের সন্ধান পেলাম। এক মাত্র হোটেল এর পাশ দিয়ে পায়ে চলার পথ রেখা ধোরে পাহাড়ে চড়তে শুরু কোরলাম। আস্তে আস্তে ড্যাম, ড্যামের পাশের হোটেল ছেড়ে আমরা অনেক ওপরে উঠে এলাম। জঙ্গল ক্রমশ ঘন হতে শুরু করলো, তার মাঝ দিয়ে হালকা পথরেখা। চারিদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া কোনো শব্দ নেই। আমাদের সঙ্গে জল নেই খাবার ও নেই, নেই কোনো গাইড এই অজানা পথে। কেবল উঠে চলেছি অজানা পাহাড়টির গভীর জঙ্গলময় বুক বেয়ে।  আমরা যখন পাহাড়টির প্রায় মাথার কাছাকাছি তখন দেখলাম ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লাঠি হাতে এক যুবক নিচে নেমে আসছে। তার সাথে কুশল বিনিময় কোরে শুরু হল গল্প। আমরা যত দূর এসেছি তার থেকে অনেক দূরে নাকি  তাদের গ্রাম। গ্রাম টির নাম জিলিং সিলিং। এমন সুন্দর নামের গ্রাম, শুনেই যেতে ইচ্ছে করছে। এ যাত্রায় আর হল না, আমাদের হাতে সময় কম তাই ফিরে যাওযার সিদ্ধান্ত নিলাম। সে চলেছে বাজার করতে পাহাড়ের নিচে, আবার ফিরতে হবে এই গভীর জঙ্গল ময় পথে। তার নাম জিজ্ঞাসা করতে অনেক্ষন চিন্তা করার পরে বললো ভালু। ভালু বললো পাহাড়ের ওপর খুব সুন্দর আমাদের গ্রাম, আমাদের কোনো অসুবিধা নেই, আমরা খুব ভালো আছি তবে এই পথ টাই  আমাদের কষ্ট। ভালু দের সুন্দর গ্রাম জিলিং সিলিং, যার নাম শুনেই আমি গ্রামটির প্রেমে পড়ে গেছি, আবার একবার আসার বাসনা মোনে লালন করে রেখে আমরা ভালুর সঙ্গে গল্প করতে করতে নেমে চললাম খয়রাবেরা ড্যামের দিকে। ভালুকে বিদায় জানিয়ে আমরা ফিরে চললাম বাঘমুন্ডির দিকে। আবার সেই পুরোনো রাস্তায়, পথের বাঁ পাশে দিগন্তেমাথা উঁচু কোরে  অযোধ্যার সুবিশাল রেঞ্জ তার সামনে চাষের জমি বিক্ষিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে কোথাও পলাশ, শাল আর খেজুর গাছ  আর এর পাশদিয়ে আমাদের রাস্তা। বাঘমুন্ডি হোয়ে আমরা যখন লোয়ার ড্যামের কাছে, সূর্যদেব চলেছে অস্ত্রাচলে। আমরা পাকদন্ডী পথে কেবল ওপরে উঠে চলেছি আর পথের বাঁ দিকের একদম নিচের ড্যামে গলিত লাভার মতো সূর্যের প্রতিচ্ছবি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। দিনের আলো শেষ হতে বেশি দেরি নেই, আমরা এসে পৌঁছলাম লোয়ার ড্যামে। লোয়ার ড্যাম দেখে আমরা পাকদন্ডী পথে উঠে চললাম আপার ড্যামের দিকে। অবশেষে এসে পৌছালাম আপার ড্যামে। আমরা যখন 
আপার ড্যামে পৌছালাম সূর্যদেব ডুবতে ডুবতে হালকা আলোর রেশ রেখে গেছে প্রকৃতির মাঝে, অপূর্ব লাগছে আপার ড্যাম ও তার আশপাশের পাহাড় গুলিকে। সন্ধ্যা নামা পর্যন্ত আমরা আপার ড্যামে থাকলাম। এদিকে পূর্ণিমার চাঁদ উঠলো আকাশের এক কোনে, আপার ড্যাম ও তার আশপাশের জঙ্গলময় পাহাড় গুলি ভেসে যেতে থাকলো তার মায়াবী আলোয়। আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম ফিরে যেতে হবে হোটেলে। গাড়ির আলোতে দেখতে পেলাম রাস্তার পাশে দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে, ওখান থেকে মুরগির মাংস নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। 
একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা মা লক্ষ্মী লজের দোতলার বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসলাম, টি টেবিলে ধোঁয়া ওঠা  চা এর কাপ এর সাথে । চা খেতে খেতে সামনে তাকিয়ে দেখি পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সামনের পাহাড় গুলি ভেসে যাচ্ছে আর দূরের কোনো পাহাড়ি গ্রাম থেকে ভেসে আসছে মন পাগল করা ধামসা মাদলের সুর। মন উতলা হোয়ে উঠলো এক বার চাক্ষুস করার জন্য। মাথায় হেড লাইট লাগিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম এই আলো আঁধারি পথে কয়েক জনকে নিয়ে। চাঁদিনী রাতেও পাহাড়ের নিস্তব্দতা আর জনমানব হীনতা গ্রাস করছে সমস্ত রাস্তা টিকে।এক সাঁওতালি গ্রামের মধ্যে দিয়ে  প্রায় অণ্ধকার আচ্ছন্ন পথের পাশে এক ঝুপড়ির মতো দোকান,  টিম টিমে আলোতে গরম ধোঁয়া ওঠা চা ও সবুজ কাঁচা শালপাতায় গরম গরম আলুর পকোড়া বিক্রি হোচ্ছে। আমরাও ঢুকে পড়লাম সেই দোকানে চা ও পকোড়ার স্বাদ নিতে। দোকানদার আমাদের উদ্দেশ্য শুনে বললো অনেক দূরের গ্রাম থেকে ধামসা মাদলের আওয়াজ আসছে, এখন না  যাওয়াই ভালো। আমরা দোকানদার কথা মতো হোটেলে ফিরে গেলাম। অনেক রাত অবধি নেশা ধরানো ধামসা মাদলের আওয়াজ শোনা গেলো। 
পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে রামকৃষ্ণ মিশনকে ডানদিকে ফেলে চললাম প্রায় এক কিলোমিটার দূরবর্তী   ময়ূর পাহাড়, পাহাড়ের মাথা থেকে অযোধ্যা টপ হিল ও পাহাড়ের রেঞ্জ দেখা যায়। পাহাড়ের মাথায় রয়েছে হনুমান মন্দির এখান থেকে এক দারুন সূর্যোদয় দেখে আমরা ফিরে এলাম পথের পাশে চা এর দোকানে। সেখানে এক সাঁওতালি বৃদ্ধ আমাদের অযোধ্যা সম্মন্ধে গল্প বোলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন বনবাস কালে রামচন্দ্র ও তার দলবল আড়াই দিন অযোধ্যাতে ছিলেন। তখন অযোধ্যাতে জলের ব্যাবস্তা কিছু ছিলো না। সীতা মায়ের অনুরোধে রামচন্দ্র মাটিতে বান মেরে জল উত্তলন করেন। পরবর্তী কালে যাহা সীতা কুন্ড নামে পরিচিত। তিনি আমাদের সীতাকুন্ড দেখে আসার অনুরোধ করলেন। চা খেয়ে আমরা চললাম সীতা কুন্ডের পথে। বাঁ দিকে রাম মন্দির ফেলে সাঁওতালি গ্রামের মধ্যে দিয়ে পথ। গ্রাম শেষ কোরে চাষের জমি তারপর ফাঁকা মাঠ, মাঠের পাশে সীতা কুন্ড। মাটির নিচে থেকে হালকা গরম জল উঠে আসছে যা সোজা আপার ড্যামে মিশছে। 
সীতা কুন্ড দেখে আমরা তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে এলাম কারণ আজ আমরা মুরগুমা ড্যামের পাশে পলাশবিতানে   থাকবো। আমাদের আগে থেকেই বুক করা আছে। ব্রেকফাস্ট কোরে তাড়াতাড়ি হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আবার সেই শাল পলাশ এর জঙ্গলের এর পাস দিয়ে পথ দিয়ে আমরা চলে এলাম বামনী ফল্স  এ। প্রধান রাস্তা থেকে অনেকটা সিড়ি বেয়ে নেমে যেতে হবে বামনী ফল্স দেখতে গেলে। রাস্তার দুই পাশে খাবার দোকানের লম্বা লাইন। বামনী ফল্স দেখে  টপ হিল থেকে প্রায় আঠেরো কিলোমিটার দূরবর্তী মুরগুমার উদ্দেশ্বে রহনা দিলাম। একের পর এক সাঁওতালি গ্রামের মধ্যে দিয়ে পথ চলে গেছে। গ্রাম শেষ কোরে এক সুন্দর  সবুজ উপত্যকায় গাড়ি এসে পৌছালো, আমরা গাড়ি দাঁড়করিয়ে দিলাম, এমন সুন্দর জায়গা যে এখানে প্রাণভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে ও চোখের আরাম হয়। আমরা অনেক্ষন এখানে আড্ডা দিলাম। অযোধ্যা পাহাড় এসে একটা জিনিস লক্ষ করছি এখানে এমন কিছু জায়গা আছে যেগুলোর ওপর এখনো প্রচারের আলো পড়েনি কিণ্তু সেই জায়গা গুলোর সব গুন রয়েছে টুরিস্ট দের ভালোলাগার মতো। উপত্যকা শেষ করে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ। একটার পর একটা পাহাড় পেরিয়ে চলেছি। এদিকে পলাশ বিতান থেকে ফোন চলে এল যে লাঞ্চে আপনারা কি খাবেন? আমরা মাছ ভাতের অর্ডার দিয়ে দিলাম। গভীর জঙ্গলের মধ্যে যেতে যেতে ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলো বললো এটা সুইসাইড পয়েন্ট। এখান থেকেই প্রথম মুর গুমা ড্যামের প্রথম দর্শন পাওয়া গেলো। গাড়ি পাহাড় থেকে নামতে নামতে এসে পৌছালো মুরগুমা ড্যামের পাশে। বিশাল এক জলাশয়, ঘন সবুজ পাহাড় দিয়ে ঘেরা। পরিয়ারি পাখিরা টুপ টুপ কোরে জলে ডুব দিচ্ছে। ড্যামের পাশদিয়ে রাস্তা সোজা চলে গেছে পলাশ বিতান ইকো জঙ্গল হাটে। আগে থেকেই টেন্ট বুক করা ছিলো। আমরা পৌঁছাতেই দুটি টু মেন টেন্ট আমাদের দেওয়া হল, আমরা চার জোন ছিলাম। টেন্টের পাশে টেবিল চেয়ার পেতে গার্ডেন ছাতা লাগিয়ে দেওয়া হল, পাশের কটেজের একটা টয়লেট আমরা ব্যাবহার করতে পারবো বোলে দেওয়া হল। বেশ সুন্দর ব্যাবস্তা। পলাশ বিতানে কটেজ রয়েছে, সুইস কটেজ টেন্ট রয়েছে আর ডোম টেন্ট রয়েছে, রয়েছে একটা ওপেন ডাইনিং বাগানে অনেক ফুল ফুটে আছে, বিশাল পার্কিং এর জায়গা, সবথেকে ভালো পলাশ বিতানের যে কোনো জায়গা থেকেই দেখা যাবে অযোধ্যার রেঞ্জ। এদিকে লাঞ্চ রেডি, আমাদের ডাক পড়লো ডাইনিং হলে। 
লাঞ্চ কোরে আমি আর পল্লব বেরিয়ে পড়লাম আশপাশটা একটু ঘুরে দেখতে। পলাশ বিতানের পিছন দিয়ে চললাম জঙ্গলের পথে। সামনেই অযোধ্যা পাহাড়ের ছোট ছোট পিক গুলি মাথা উঁচু কোরে দাঁড়িয়ে আছে যেন হাতছানি দিয়ে আমাদের ডাকছে। আমরাও মোহাবিষ্ট হোয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। পথের ডানদিকে অৰ্থাৎ ড্যামের উল্টো দিকে পর পর বেশ কয়েকটি হোটেলে হয়েছে। সেখানেও কটেজ টেন্ট সবই রয়েছে। থাকার পরিবেশ সবকটারি ভালো। আমরা সামনের পাহাড় লক্ষ কোরে হেঁটে চলেছি, শুরু হলো শাল ও পলাশের গভীর জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যেও বেশ কয়েকটি হোটেলে হয়েছে, দারুন পরিবেশ, দেখলেই থাকতে ইচ্ছে করবে। হাঁটতে হাঁটতে একদম পাহাড়ের কোলে এসে পৌঁছালাম। গ্রামের মহিলারা কাঠ কেটে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে ঘরে ফিরছে, রাখালরা গরুর পাল মাঠে ছেড়ে দিয়ে ঘাস খায়াচ্ছে। পথের পাশে কাঠের বোঝা বাধঁতে থাকা এক কিশোরকে পেয়ে অনেক গল্প কোরলাম। তাদের গ্রাম এখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। আমরা প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছি। তার কাছেই জানলাম এদের কাছের স্টেশন বেগুনকোদার কিন্তু ভুতের ভয়ে এরা ঝালদা দিয়ে যাতায়াত করে। বেগুনকোদারে মাত্র দুটি ট্রেন দাঁড়ায়। ভারতীয় রেল বেশ কয়েকটি ট্রেন চালু করেও পরে বন্ধ কোরে দিয়েছে। বেগুনকোদার এদের কাছে ভুতের স্টেশন। এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসবে তাই আমরা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফেরার পথে মুরগুমা ড্যামের উপর অপার্থিব সূর্যাস্ত দেখলাম। পথের পাশেই ভোজনালয় নামের রেস্টুরেন্ট, এদেরও কয়েকটা টেন্ট রয়েছে। আমরা চা খেয়ে যখন ফিরছি, হোটেলে হোটেলে আলো জ্বলে উঠেছে টেন্ট গুলির মধ্যে জ্বলতে থাকা আলোয় অদ্ভুত সুন্দর লাগছে টেন্ট গুলিকে। আজকে ঠান্ডাটাও একটু বেশি। তাই আমাদের হোটেলের দীপকদা  কাঠ এনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। কাঠের আগুনে মুরগির মাংসোর সিক কাবাব বা তন্দুরি যাই বলুন বানিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া চললো। 
পরদিন খুব সকালে উঠে আমরা জল ও বিস্কুট সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মুরগুমা এক্সপ্লোর করতে।মুরগুমায় গেলে সবথেকে বড়ো একটা রকফেস সবার চোখে পড়বে। রকফেস দিয়ে না উঠে আমরা একটা সমভাব্বো ট্রেক রুট দেখে রেখে ছিলাম। সেই পথ ধরেই শুরু হলো আমাদের পথ চলা। গাছপালা শেষ হোয়ে শুরু হলো রুক্ষ পাথুরে চড়াই পথের। যত ওপরে উঠছি মুরগুমাকে ততই অপরূপ লাগছে। কঠিন চড়াই পথে আমরা উঠে এলাম দূরথেকে দেখা পাহাড়টির মাথায়। মুরগুমা এলে যার তীব্র হাতছানি উপেক্ষা করা দায়। পাহাড়ের মাথায় রয়েছে একটা মন্দির। পাহাড়ের মাথা থেকে দূরের ঢেউখেলানো পাহাড়ের রেঞ্জ গুলি খুব সুন্দর লাগছে এই আলো আঁধারিতে । সমস্ত প্রকৃতি যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে, এদের ঠিক পিছন থেকেই ঘন  লাল সূর্য উঠে সমস্ত প্রকৃতিতে প্রাণের সঞ্চার করলো। সেখান থেকে ওম নিয়ে আবার একটা নতুন দিনের হলো শুরু। আমরা অপার্থিব এক সূর্যোদয়ের সাক্ষী হোয়ে থাকলাম। মুরগুমায় নেমে এসে ব্রেকফাস্ট কোরে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম বেগুন কোদার হোয়ে বাড়ির পথে। 
...........................................................
কি ভাবে যাবেন -ডানকুনি  থেকে আরামবাগ হোয়ে ধলডাঙা মোড় হোয়ে পুরুলিয়া, টামনা, সিরিকাবাদ হোয়ে অযোধ্যা টপ হিল 258কিলোমিটার পথ।প্রাইভেট গাড়িতে  সাত ঘন্টা লাগবে বিশ্রাম নিয়ে। রাত্রি এগারোটার সময় বেরোলে সান রাইস এর  সময় অযোধ্যা পাহাড় পৌঁছাবেন। খুব ভালো লাগবে। 
বাইকে একটু বেশি সময় লাগবে। 

ট্রেনে কিভাবে যাবেন -হাওড়া থেকে আদ্রা চক্রধর পুর ফাস্ট প্যাসেনঞ্জার এ বরাভূম অথবা পুরুলিয়া স্টেশন নেমে সেখান থেকে গাড়িতে অযোধ্যা টপ হিল। 

কোথায় থাকবেন -
অযোধ্যা পাহাড় টপ হিল -
মা লক্ষ্মী লজ 
Ph -7384900915
বিরসা মুন্ডা লজ -9002462589
খয়রাবেরা ড্যাম -
ইকো এডভেঞ্চার ক্যাম্প -9830169694
Www.ecoadventureresorts.com 
মুরগুমা ড্যাম -
পলাশ বিতান ইকো জঙ্গল হাট 9674222675/9674222670/9831347123.
মুরগুমা ইকো হাট 
8013082949/9073262726
শাল পিয়ালীর কুঠির 
7059262941/912903963/6289352996
মহুলবনি জঙ্গল ইকো রিসোর্ট 
9153170454/9593959582/9091520192
ভালো সময় -মূলত শীতের সময়টাই বেশী টুরিস্ট হয়। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারীর শেষ ও মার্চের শুরুতে এই অঞ্চলে প্রচুর পলাশ ফোটে তখন আগে থেকে ঘর বুক না করা থাকলে ঘর পাওয়া যাবে না। ভরা বর্ষাতেও এখানে টুরিস্ট আসেন। গরমের দিনগুলিতেও টুরিস্ট আসেন, এই সময় বিকালের দিকে গায়ে হালকা চাদর দিতে হয়। 
ট্যুর প্ল্যান -
তিনরাত থাকার  প্ল্যান করলে অযোধ্যার এই অঞ্চলটি ভালোভাবে ঘোরা যায়। দু রাত থাকার প্ল্যান করেও অনেকে অযোধ্যা ঘুরে আসেন। 
প্রধান দ্রষ্টব্যঃ 
ময়ূর পাহাড়, রামমন্দির, সীতা কুন্ড, কাঠের দূর্গা মন্দির, আপার ড্যাম, লোয়ার ড্যাম, মার্বেল লেক, বামনী ফল্স, তুর্গা ফল্স, তুর্গা ড্যাম, মুখোশ গ্রাম চরিদা, পাখি পাহাড়, মাঠা পাহাড়, দুয়ারসিনি জঙ্গল, খয়রাবেরা ড্যাম, মুরগুমা ড্যাম। 

**  অযোধ্যা টপ হিল ও মুরগুমাতে ক্যাম্প ফায়ারে ছৌ নাচ অথবা  সাঁওতালি নাচের ব্যাবস্তা হোটেল মালিক কোরে দেয়। খরচ তিনহাজার থেকে তেত্রিশশো টাকা। 









মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রহস্যময় রূপকুন্ড

শিলাবতী নদীর তীরে গণগনি।

উইকএন্ড ট্রিপে পাল্লা রোড